উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবিতার বোঝাপড়া
ঢাকায় শশী থারুরকে স্বচক্ষে দেখতে পাব, আলোচনায় উপস্থিত থাকতে পারব, এটা ছিল আমার জন্য উত্তেজনাকর অভিজ্ঞতা। লক্ষ লক্ষ দক্ষিণ এশীয়র মতো আমিও বছর তিনেক আগে লন্ডনে ব্রিটেনের কাছ থেকে ভারতের ক্ষতিপূরণের দাবি উত্থাপনে শশী থারুরের বাক-বৈদগ্ধের শক্তিমত্তায় বিস্মিত হয়েছি। ঢাকা লিটফেস্টে ২০১৯ এর প্রণিধানযোগ্য কয়েকটি আলোচনার মধ্যে দুটি ছিল দ্বিতীয় দিনে প্রখ্যাত ভারতীয় লেখক এবং সাংসদ শশী থারুরের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে প্যানেল আলোচনা ‘শেখ মুজিব : উত্তর-ঔপনিবেশিক মুক্তিসংগ্রামের আইকন’ এবং তৃতীয় ও শেষ দিনে ভারতের সেক্যুলার রাষ্ট্র চরিত্রের মৌল পরিবর্তন নিয়ে অধ্যাপক সি আর আবরারের সঙ্গে আলাপ ‘ভারতের বিরুদ্ধে ভারত’। উত্তর-ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-ভারতের তিন খণ্ড নতুন রাষ্ট্রের ইংরেজ শাসন পরবর্তী সংকট, আত্ম-বিরোধ, সংগ্রাম এবং নেতৃত্ব নিয়ে এ দুটি আলোচনাকে বিশেষভাবে বলা যায় চিন্তা উদ্রেককারী সর্বশেষ ভাষ্য।
দক্ষিণ এশিয়ার আইকনিক নেতা মুজিবকে নিয়ে শশী থারুরের সঙ্গে আফসান চৌধুরীর ভাব-বিনিময় ছিল উপভোগ্য ও প্রাণবন্ত। আফসান চৌধুরী আলোচনায় এমন কিছু উপাদান নিয়ে আসেন তাতে দর্শক-শ্রোতাদের চিন্তার রসদ জোগায়। আইকনিক নেতা হিসেবে শেখ মুজিবকে শশী থারুরের মূল্যায়নের মূল জায়গাটি ছিল, স্বয়ং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতাকে কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করা, ব্রিটিশ-ভারত পরবর্তীকালের রাষ্ট্রের ভেতরেই নতুন ধরনের শাসন-পীড়নকে প্রতিরোধের শক্তিশালী প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো, পূর্ব-বাংলা অথবা পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে যে প্রতিরোধের শক্তিগুলো উত্থিত হচ্ছিল, সেগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে নতুন রাষ্ট্র গঠনের ভাবনা, আত্মবিশ্বাস ও সাহসের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের মর্মান্তিক হত্যার পরবর্তীকালে একদিকে যেমন এই আইকনিক নেতাকে নিয়ে সকল আলোচনাকে সামরিক সরকারগুলো গায়েব করে দিয়েছিল, কার্যত ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল, তেমনি আবার আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পরে ২০০৯-১৯ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে শেখ মুজিব নিয়ে ভক্তির আতিশয্যে অতি বিশেষণ প্রয়োগের ফলে তার সম্পর্কে কোনো বস্তুনিষ্ঠ সিরিয়াস ঐতিহাসিক মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবী, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক কর্মী এবং জনসাধারণের জন্য এই মূল্যায়ন জরুরি। শশী থারুর এবং আফসান চৌধুরীর এই আলোচনা আমাদের একটা সিরিয়াস আলোচনা-বোঝাপড়ার পথ খুলে দেয়।
শশী থারুরের আলোচনা থেকে আমরা খানিকটা বাইরে থেকে দেখা একটা দৃষ্টি লাভ করি, যা আমাদের অতি চেনা, অতি উদ্ধৃত মুজিব আলোচনায় ধরা পড়ে না। ছোটবেলায় কলকাতায় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিবকে দেখার বালকের বিস্ময়াভিভূত স্মৃতি থেকে বলেন যে তার উপস্থিতি, ব্যক্তিত্বের কারিশমা ও বাগ্মিতা কীভাবে জনসভায় একটা সম্মোহন সৃষ্টি করেছিল। তিনি বলেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে ইংরেজ উপনিবেশকারীকে চিহ্নিত করা ছিল সহজ, স্বাধীন পাকিস্তানে সেটা ছিল বিভ্রান্তিকর। পাকিস্তান নামের এই রাষ্ট্র একভাবে জনগণের আকাক্সক্ষায় সৃষ্টি হয়েছে, আবার হয়নিও। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এই অন্তর্গত দ্বন্দ্ব থেকে মুজিব নতুন ধরনের নেতৃত্ব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। সেখানেই মুজিব পূর্ববর্তী আইকনদের চেয়ে একটি স্বতন্ত্র ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছেন। অভ্যন্তরীণ উপনিবেশকে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-কৃষক-বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করলেও একে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শেখ মুজিব এমনভাবে উত্থিত হয়েছিলেন, এমন একটি ভূমিকা নিয়ে সক্ষম হয়েছিলেন, যা ছিল অনন্য ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। শেখ মুজিব ১৯৭০-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েও সরকার গঠন করতে পারেননি, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নামের নতুন একটি রাষ্ট্র গঠনের দিকে চলে যায়।
আফসান চৌধুরী শেখ মুজিবকে দেখেছেন গোপালগঞ্জের মতো একটা ছোট্ট মফস্বল শহর থেকে আসা ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ করা নেতা হিসেবে। আফসানের বক্তব্যের একটা মূল জায়গা ছিল যে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে কেবল শ্রেণিভিত্তিক রাজনৈতিক এজেণ্ডা নিয়ে সফল হওয়া যায়নি। মধ্যবিত্তের এজেণ্ডা ছাড়া কোনো জাতীয় আন্দোলন সফল হয়নি। কৃষক, মধ্যবিত্তের সঙ্গে যুক্ত হয়েই কেবল রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক সাফল্য লাভ করেছে। শেখ মুজিব যুগপৎ কৃষক এবং মধ্যবিত্তের এজেণ্ডাকে সমন্বিত করে জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। গান্ধী, নেহরু, সুভাস বোস, জিন্নাহ, আবুল কালামের মতো এলিট অংশ থেকে মুজিব আসেননি, তিনি উঠে এসেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কৃষক সমাজের এক প্রেক্ষাপট থেকে, যার ফলে তিনি যেমন কৃষককে বুঝতেন, তেমনি দেশের কৃষক সমাজও তার সঙ্গে প্রাণের নৈকট্য অনুভব করত, তাদের নিজেদের নেতা জ্ঞান করত। আফসান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণার সময় অজস্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন যে, মুজিবের সমর্থনের আসল ভিত্তি ছিল গ্রামে, কৃষকদের মধ্যে। কৃষকদের ভাবনা এবং তাদের দাবি-দাওয়ার তিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন, আবার একই সঙ্গে গ্রামীণ ও শহুরে মধ্যবিত্তের আকাক্সক্ষাকেও এর সঙ্গে সমন্বিত ও ধারণ করেছেন। এর ফলে দুই শ্রেণির মধ্যে একটি অবিসংবাদিত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেন এবং একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বেগবান করে এর পুরোভাগে চলে আসেন। এখানেই তার কারিশমা। বাংলাদেশের শ্রেণি রাজনীতির বাস্তবতা এবং কৃষক সমাজকে গভীরভাবে বুঝতে পেরেছেন বলেই তার সমর্থন এসেছিল সমাজের গভীর জায়গা থেকে। মুজিব উত্তর-ঔপনিবেশিক স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে নিজের ভেতরের অভ্যন্তরীণ শাসন-শোষণকে, অঞ্চলকে অঞ্চলের পদানত করবার প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে রাজনীতির মঞ্চে সার্থকভাবে অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা তাকে দক্ষিণ এশিয়ার এক আইকনে পরিণত করে। শশী থারুর আফসান চৌধুরীর এই বিশ্লেষণ দৃশ্যত গ্রহণ করেন, সেখান থেকে যুক্ত হন বৃহৎ আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে আছে মুজিবের প্রতি কংগ্রেসীয় সমঝদারি।
পরদিন শশী থারুরের দ্বিতীয় আলোচনা সঞ্চালন করেন অধ্যাপক আবরার, যেটা শুরু হয় অক্সফোর্ড ইউনিয়নে শশী থারুর ব্রিটেনের ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি এবং তার হিসাব সাক্ষ্য-প্রমাণ সমেত উপস্থাপনের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তৃতা থেকে। তার মূল বক্তব্য ছিল, ভারত কীভাবে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে এক অসামরিক ও অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলে সকলের জন্য এমন একটি মুক্ত দেশের আকাক্সক্ষা করবার পরে এখন নিজেই নিজের ভারতীয় চেতনার মৌলিক জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছে। পরমতসহিষ্ণুতা এবং হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান– সকল ধর্ম-বর্ণের বহুজাতির রাষ্ট্র হওয়াই ছিল ভারতীয় মৌল আদর্শ। সহিষ্ণুতার ব্যাখ্যা তার কাছে এমন: আমি সঠিক, তুমি ভুল। কিন্তু আমি তোমার ভুল করবার অধিকার উদারতার সঙ্গে স্বীকার করি। আমি বিশ্বাস করি আমার সত্যে, তুমি বিশ্বাস করো তোমার সত্যে, আমি তোমার সত্যকে সম্মান করি, তুমিও আমার সত্যকে সম্মান করবে। কিন্তু, ভারত এখন দাঁড়িয়েছে ভারতেরই বিরুদ্ধে। কাশ্মীরের ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, আসামের এনআরসির নামে লক্ষ লক্ষ নাগরিকদের রাষ্ট্রহীন করা, মুসলিম পীড়ন করে একটি হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যাওয়াÑ মূল ভারতীয় চেতনার পরিপন্থি। হালের পরিস্থিতিতে ৭০ বছর ধরে রক্ষিত ভারতের সেক্যুলার রাষ্ট্রের চরিত্র মৌলিকভাবে বদলে হিন্দু ভারতে পরিণত হয়েছে। ভারত কখনই একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের চিন্তাকে গ্রহণ করেনি এবং মুসলমানের জন্য আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের ধারণাকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। সেখান থেকে এখন নিজেই হিন্দুর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ভারত তার নিজের আদর্শেরই বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে।
অধ্যাপক আবরার বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার অভিন্ন নদীর পানি ভাগ, বঙ্গোপসাগরে নজরদারি, সীমান্তে হত্যা প্রভৃতি উত্তপ্ত ইস্যুগুলো এবং দর্শকদের প্রশ্নগুলো হয়তো কৌশলগত কারণেই এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এই আলোচনা আমাদের ইতিহাসের একটি বিপজ্জনক মোড়ে দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধিতা থেকে বেরিয়ে আসবার বুদ্ধিবৃত্তিক অনুপ্রেরণা দেয়।
নভেম্বর ১০, ২০১৯, ঢাকা