ভয় ও মৃত্যুর রাজনীতি

বাংলাদেশ এই মুহূর্তে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত এবং সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২৪ ঘণ্টায় ৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে। কেবল একটি হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় ১,৩০০ জন রোগীর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এবং এ পর্যন্ত ৯৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে (প্রথম আলো, ৬ আগস্ট ২০১৯ এবং দি টেলিগ্রাফ ৩১ জুলাই, ২০১৯)। বাংলাদেশে প্রতি বছর মৌসুমি ঋতুতে জুন থেকে অক্টোবরে জমে থাকা বদ্ধ পানিতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননের ফলে ফ্লু’র মতো লক্ষণযুক্ত এই রোগ বিস্তার লাভ করে। কিন্তু এ বছরের ডেঙ্গুর বিস্তার নজিরবিহীন। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে সরকারি হিসেবেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে।

পত্রিকায় আসা এই নির্লিপ্ত নৈর্ব্যক্তিক সংখ্যাগুলো থেকে আমরা ডেঙ্গুর দ্রুত বিস্তারে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং জীবনের নিরাপত্তা, স্বাভাবিক মৃত্যুর সম্ভাবনা হ্রাসের ফলে পরিবারগুলো কীভাবে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে তার কিছুই আন্দাজ করতে পারি না, অনুভবও করতে পারি না। রোগ-শোকগ্রস্ত, পরিবার-পরিজনের মৃত্যুশোকে মুহ্যমান, আর্থিক, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হাজার হাজার পরিবারের ক্ষয়ক্ষতি, ভীতি, বিপন্নতা পরিমাপ করা এই মুহূর্তে অসম্ভব। দেখা যাচ্ছে, স্বামী স্ত্রীকে কবরে শুইয়ে কন্যার রোগশয্যায় দৌড়ে এসেছেন। নগরীর মোহাম্মদপুর সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ১১ বছরের রাইয়ান সরকারকে কবরে শুইয়ে বাবা মমিন সরকার ও মা জান্নাত আরা জাহান ৬ বছরের মেয়ে মালিহাকে হাসপাতালে ভর্তি করে সন্তানের প্রাণভয়ে কম্পিত। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নাজমুল হকের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শারমিন শিশুপুত্রকে মাতৃহারা করে তিন দিনের জ্বরে ভুগে ৫ আগস্ট প্রাণ হারান। হাজারীবাগের বাসিন্দা ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ফাতেমা আকতার শান্তা জিগাতলার জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় গত রবিবার, ৪ আগস্ট। এইদিনই ফাতেমার বাবা শামসুদ্দিন মিয়া, একমাত্র ভাই তানভীর আহমেদকে ডেঙ্গু আক্রান্ত অবস্থায় শ্যামলীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মা আকলিমা বেগমকেও একই হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। পরদিন সোমবার তাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কাশিমনগর গ্রামে তাকে দাফন করা হয়। তার চাচাত ভাই রুবেল, তার স্ত্রী নুসরাত, দাদি ও খালা গ্রামের বাড়িতে তার মৃতদেহ নিয়ে যায়। যেসব বাচ্চারা, মায়েরা রাস্তায় থাকে, তাদের কী হচ্ছে, সেটা কল্পনা করবার শক্তিও খুঁজে পাই না।

এ রকম হাজার হাজার মানুষ এখন প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে এবং প্রতিদিন মৃত্যুর খবর দিয়ে আমাদের দিন শুরু হচ্ছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের বা নগর প্রশাসন এই পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও অসংগঠিত। এডিস মশার প্রজনন ও বিস্তারের ওপর কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপে মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা মানুষদের নিয়ে কোনো জরুরি সমন্বিত কার্যকরী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও দেখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, জনস্বাস্থ্যের দেখভালের দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানের এবং ব্যক্তিদের বিচিত্র লোক দেখানো প্রস্তুতিবিহীন আচরণ এবং কর্মকাণ্ডে জনগণ ভরসা খুঁজে পাচ্ছে না।

নগরীতে ঘরে ঘরে মৃত্যুভয়ের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এই অস্বাভাবিক মৃত্যুকে আমরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শুরু করেছি। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে আমরা মেনে নিয়ে চলছি। ক্রসফায়ার, গুম-খুন, ধর্ষণ, পুড়িয়ে মারা, গণপিটুনিতে মারা, ভিআইপি বাহনে, ফেরি আটকে, অ্যাম্বুলেন্সে কিশোরের মৃত্যুÑ রোজকার জীবনে বিচিত্রভাবে জনমানুষের মৃত্যুকে বাংলাদেশে নাগরিক জীবনের স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার একটি প্রক্রিয়া চলছে অনেক দিন ধরে। অকাল অস্বাভাবিক অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর মিছিলের ভেতর জনসাধারণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে খেয়ে-পরে, উৎসব করে জীবন-যাপন করে যাচ্ছে। যারা বেঁচে আছে, তারা যে কোনো সময় মৃত্যুর কড়ানাড়া শোনার অপেক্ষায় ভয়ে-আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। যারা মৃত্যুবরণ করছেন, এবং যারা বেঁচে আছেন উভয়কেই এই আতঙ্ক বিমানবিক করে তুলেছে। না আছে আমাদের মৃতের প্রতি সম্মান, না জীবনের প্রতি মর্যাদা। এই মৃত্যু নিয়ে অপদার্থ নিষ্কর্মা নিশ্চুপতা আমাদের মনুষ্যত্ব নষ্ট করে দিচ্ছে। আমাদের প্রথমে এই মূল সামাজিক সম্মতিতে পৌঁছাতে হবে যে, প্রত্যেক জীবন অমূল্য, কেননা আমরা কেউ কখনো জীবন সৃষ্টি করতে পারব না। প্রত্যেকটি মানুষ অপ্রতিস্থাপনযোগ্য, বিনিময়অযোগ্য সম্পদ, জাতির জন্য স্রষ্টার উপহারস্বরূপ। জীবন নিয়ে অবহেলা কেবল অনৈতিকই নয়, পরিষ্কারভাবে অপরাধমূলক আচরণ। জীবিতরা মৃতদের প্রতি দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। আমরা যারা বেঁচে আছি তারা কোনো না কোনোভাবে স্বজনদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়দায়িত্ব বহন করি।

কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জীবন নিয়ে এই হেলাফেলার সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে মৃত্যুর রাজনীতির খেলায়। ক্ষমতার রাজনীতি মৃত্যুকে স্বাভাবিক করে করে তুলেছে। ব্যক্তি হিসেবে, নাগরিকরা এই সংস্কৃতির শিকার হয়ে পড়েছে, মৃত্যুর রাজনীতির বশীভূত হয়ে পড়েছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যু দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আম-জনতা নিষ্ক্রিয়তা ও বিচ্ছিন্নতার ফাঁদে পড়ে উপায়ন্তরহীনভাবে রাষ্ট্রের ওপর ভরসা হারিয়ে পরিত্রাণের জন্য নিরাকার ওপরওয়ালার নাম জপ করছে। এই ভয়, আতঙ্ক, গণমৃত্যু আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনের অপকৌশল।

২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী নয়, যেমন ছিল আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আবিষ্কারের আগে। ডেঙ্গু কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও নয়, এটি সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট সংকট এবং স্বাস্থ্য-প্রশাসনিক-আমলাতান্ত্রিক বিপর্যয়, ডেঙ্গু একটি পরিবেশ বিপর্যয়। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর মশা জন্মেছে এবং বিস্তারলাভ করেছে নগর প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতার বদ্ধ জলাশয়ে। ঢাকার মতো একটি মনোরম নগরী যেটি ওস্তাদ নগর পরিকল্পকের মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিল, তাতে যত্রতত্র যথেচ্ছ নির্মাণ করে, পরিকল্পিত বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে না তুলে, গণযোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না তুলে, সবুজ খোলা জায়গা না রেখে পৃথিবীর নিকৃষ্ট বাসযোগ্য শহরে পরিণত করা হয়েছে। ঢাকা একটি মানব-সৃষ্ট সংকট। কিন্তু এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী শক্তি বিচিত্র বাগাড়ম্বরে আত্মগোপন করে থাকছে।

আমাদের সহজ সাদামাটা প্রশ্ন হলোÑ এই মৃত্যু মধ্যযুগের প্লেগের মতো নিবারণ অযোগ্য কি? না। যদি তাই হয়, তাহলে মানুষ বাঁচানোর জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করা হয়েছে কি? না। এডিস মশা বিস্তার রোধে নগর প্রশাসন, ডেঙ্গুর চিকিৎসায় স্বাস্থ্য প্রশাসন, মন্ত্রণালয়, সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ নিয়েছে কি? না। এমনকি সন্তোষজনক পদক্ষেপ নিয়েছে কি? না। বরং, এই জীবন-মরণের গুরুদায়িত্বশীল পদে কর্মরত ব্যক্তিদের অসংলগ্ন কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ড অবিশ্বাস ও অনাস্থার সৃষ্টি করে। নাগরিকদের জীবন-মরণের হর্তাকর্তা হওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, অপরাধমূলক অবহেলাকে তদন্তের আওতায় আনতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক খাটনি করার দরকার। এখনো যারা বেঁচে রয়েছি, মৃতদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো এই অপরাধগুলোকে উন্মোচন করা। এটা কেবলমাত্র কোনো ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড মাত্র নয়। কোনো এক মন্ত্রীর বদলে এর বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হবে না। এটি একটি বৃহৎ সিস্টেমের থেকে উৎপাদিত। আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার একটি কাঠামোগত কৌশল-মৃত্যুর রাজনীতি।

প্রাতিষ্ঠানিক ইতালীয় দার্শনিক গিয়রগি আগামবেন মৃত্যুর গ্রিক দেবতা ‘থানাটোস’-এর নাম অনুসরণে একে নাম দিয়েছেন ‘থানাটোপলিটিক্স’ (১৯৮৫) । নাগরিকের দেহের ওপর, জীবন-মরণের ওপর আধুনিক যুক্তিশীল রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুঁকো বলেছেন জৈব-রাজনীতি। জৈব-রাজনীতি হলো, অসংখ্য ও বিচিত্র কলাকৌশলে জনগণের দেহ-প্রাণ ও জনসংখ্যার ওপর আধিপত্য কায়েম করা (ফুঁকো, যৌনতার ইতিহাস, ১৯৭৬, পৃ ১৪০), যেমন রাষ্ট্র কর্র্তৃক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, টীকা নিতে বাধ্য করা, গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেওয়া, জনস্বাস্থ্য বিধানে নাগরিকের দেহের ওপর বিভিন্নভাবে কর্র্তৃত্ব প্রয়োগ করা ইত্যাদি। এই জৈব-রাজনীতির ধারণাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম ও বিস্তারে মৃত্যুর ব্যবহারকে আগামবেন থানাটোপলিটিক্স বলেন। থানাটোপলিটিক্স-এর ধারণা দিয়ে আমরা বুঝতে পারব, কেন এই গণমৃত্যুর জবাবদিহি নেই? কেন প্রতিদিন অকাল মৃত্যুকে জাতীয় জীবনের অঙ্গ করে তোলা হয়েছে? কীভাবে এই নির্বিকারপনা টিকে আছে? কীভাবে জনসাধারণ নিষ্ক্রিয় ও বশ্য হয়ে পড়েছে? আর আমরা কি-ই বা করতে পারি?

বিশেষ করে গণহারে মৃত্যু এবং ত্রাস সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের অসম্মতির মধ্য দিয়ে ঠেলে নেওয়ার বৈধতা অর্জন করে অথবা অপশাসনের পক্ষে সম্মতি সৃষ্টি করে। আইনকানুন, প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্য দিয়ে নাগরিকের দেহকে বশ্য, অধীনস্ত করে তাদের জীবন-মরণের বৈধ মালিক বনে যায়। কিন্তু আবার জনপ্রতিরোধ দেখা দিলে, ‘হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে’ বলে জনরোষের মুখে পলায়নপর অবস্থান গ্রহণ করে। বেঁচে আছি বলে আমাদের এই থানাটোপলিটিক্সকে উন্মোচন করতে মগজ খাটানোর কাজ করে যেতে হবে। নিষ্কর্মা অপদার্থ নিষ্ক্রিয় পরিস্থিতি থেকে নিজেদের মুক্ত করে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে।

Originally Published in Desh Rupantor